• জাতিগত বিদ্বেষ : রেলগাড়ির কামরা, স্টেশনের প্রতীক্ষা শালা, হোটেল, পার্ক, ক্লাব, সাঁতার কাটার জায়গা, খেলার মাঠ প্রভৃতি সর্বসাধারণের ব্যবহারের স্থানগুলি ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষিত থাকতো। পদস্থ ভারতীয়দের প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করতেও তারা দ্বিধা করত না। 1809 খ্রিস্টাব্দে এক সাহেবের সামনে পালকি চড়ে রাজা রামমোহন রায় অপমানিত হয়েছিলেন। 1873 খ্রীষ্টাব্দে পালকি চড়ে যাওয়ার সময় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্নেল ডাফিনের হাতে প্রহূত হন। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কে তার চটির জন্য কলকাতা মিউজিয়াম এ প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
• চাকরিতে বঞ্চনা : 1876 খ্রিস্টাব্দে এক আইন পাস করে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বয়স 21 থেকে কমিয়ে 19 করা হয়। 19 বছরের একজন ভারতীয় যুবকের পক্ষে লন্ডনে গিয়ে এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া এক রকম অসম্ভব ছিল। 1853 খ্রিস্টাব্দে প্রতিযোগিতামূলক সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। 1874 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সার্ভিসে ভারতীয়দের সংখ্যা ছিল মাত্র 5 জন। 1887 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের 900 টি পদের মধ্যে ভারতীয় ছিল মাত্র 16 জন।
• অর্থনৈতিক শোষণ : ইংরেজদের আর্থিক শোষণের ফলে 1865 থেকে 1880 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকটি ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। 1877 খ্রীষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষ প্রায় দু লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে 360 লক্ষ মানুষকে পিরিত করেছিল। এমতাবস্থায় আফগান যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য লড লিটন ভারতীয়দের উপর নতুন কর চাপান এবং ভারতীয় রাজস্ব থেকে কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করে মহারানী ভিক্টোরিয়ার সম্মানার্থে মহাসমারোহে দিল্লি দরবার অনুষ্ঠিত করেন। দাদাভাই নওরোজি তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'পভার্টি এন্ড আন-ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া', রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর 'ইকোনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া', এবং মহাদেব গোবিন্দ রানাডে 'ইন্ডিয়ান ইকনোমি' গ্রন্থ মারফত ইংরেজদের স্বৈরাচারী শাসনের স্বরূপ দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন।
• দেশাত্মবোধক সাহিত্যের বিকাশ : বাংলা সাহিত্যে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনাতেই সর্বপ্রথম জাতীয়তাবোধের স্ফুরণ দেখা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'তিলোত্তমা', 'শর্মিষ্ঠা', 'কৃষ্ণকুমারী' নাটক ও 'মেঘনাদবধ' কাব্য বাংলা সাহিত্যে এক নব যুগের সৃষ্টি করে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মিলে সব ভারত সন্তান', মনোমোহন বসুর 'দিনের দিন সবে দীন ভারত হয়ে পরাধীন', গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘লজ্জায় ভারত যশ গাহিব কি করে' প্রভৃতি সঙ্গীতগুলি স্বদেশী ভাবের উদ্বোধনে যথেষ্ট সাহায্য করে। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কর্মদেবী’, ‘শূরসুন্দরী’, ‘কাঞ্চীকাবেরী’, 'পদ্মিনী উপাখ্যান' প্রভৃতি কাব্য আত্মোৎসর্গে উদ্বুদ্ধ করে। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য, 'ভারত বিলাপ', 'ভারত ভিক্ষা', ‘ভারত সংগীত' এবং নবীনচন্দ্র সেনের ‘রৈবতক’, 'কুরুক্ষেত্র', ‘প্রভাস’ ও ‘পলাশীর যুদ্ধ' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য রচনা। রমেশ চন্দ্র দত্তের ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত' ও ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা' উপন্যাসের শিবাজীর নেতৃত্বে মুঘলদের বিরুদ্ধে মারাঠা এবং মোগলদের বিরুদ্ধে রাজপুতদের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদের উন্মেষে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ধর্মতত্ত্ব’ ও' কৃষ্ণচরিত্র' গ্রন্থ এবং ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানী' ও ‘সীতারাম’ উপন্যাস এর ভূমিকা অপরিসীম। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ তাকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ঋষি' এবং মনীষী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাকে 'The real Father of Indian Nationalism’ বা ‘স্বজাত্যবোধের আদ্যাচার্য' বলে অভিহিত করেছেন।
• নাটকের ভূমিকা : দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকে নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার ও দেশবাসীর সীমাহীন দুর্দশা চিত্র ফুটে উঠেছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ‘পুরুবিক্রম’, 'সরোজিনী', ‘অশ্রুমতি’ ও ‘স্বপ্নময়ী’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ', 'একেই কি বলে সভ্যতা', দক্ষিণাচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘চা কর দর্পণ', মীর মোশারফ হোসেন এর ‘জমিদার দর্পণ', উপেন্দ্রনাথ দাস এর ‘শরৎ সরোজিনী' ও ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী' অমৃতলাল বসুর ‘হীরকচূর্ণ’, ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ', গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সিরাজদৌলা’, 'মীরকাসিম', 'ছত্রপতি শিবাজী' এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘প্রতাপসিংহ’, ‘দুর্গাদাস’, ‘মেবার পতন', ‘শাজাহান’ প্রভৃতি নাটক দেশবাসীর মনে প্রবল স্বজাত্যবোধের জন্ম দেয়।
• সংবাদপত্রের ভূমিকা : জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য বাংলা সংবাদ পত্র গুলি হল – দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘সোমপ্রকাশ’ (নীলকরদের অত্যাচার ও সমকালীন রাজনীতি), ভূদেব মুখোপাধ্যায় এর ‘শিক্ষাদর্পণ' (জাতিবৈরিতা সম্পর্কিত রচনাবলী), অক্ষয় চন্দ্র সরকার এর ‘সাধারণী’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’, যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘আর্য দর্শন' (মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি ও ইতালির অন্যান্য বিপ্লবীদের জীবনী প্রকাশিত হতো), কেশবচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘সুলভ সমাচার', কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ। 1868 খ্রিস্টাব্দে শিশির কুমার ঘোষ সম্পাদিত ‘অমৃতবাজার পত্রিকা' প্রথমে যশোর থেকে প্রকাশিত হয় এবং 1872 খ্রিস্টাব্দে পত্রিকাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। 1878 খ্রিস্টাব্দে লর্ড লিটন ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন' প্রণয়ন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে উদ্যোগী হলে পত্রিকাটি ইংরেজি পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। 1853 খ্রিস্টাব্দে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট' জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। কিশোরী চাঁদ মিত্র সম্পাদিত ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড', মনমোহন ঘোষ সম্পাদিত ‘ইন্ডিয়ান মিরর', শম্ভু চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর ‘মুখার্জীস ম্যাগাজিন', গিরিশচন্দ্র ঘোষ সম্পাদিত ‘বেঙ্গলি’ এবং নবগোপাল মিত্রের ‘ন্যাশনাল পেপার' জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিস্তারে বিশেষ স্থান অধিকার করে। বাংলার বাইরে ইংরেজি এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকার গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - মাদ্রাজের সুব্রক্ষ্মন্য আয়ারের ‘হিন্দু’ ও ‘স্বদেশমিত্রম’, বাল গঙ্গাধর তিলকের ‘কেশরী’ ও ‘মারাঠা’, দাদাভাই নওরোজির ‘দি ভয়েস অফ ইন্ডিয়া', পাঞ্জাবের সর্দার দয়াল সিং মাজিতিয়ার ‘লাহোর ট্রিবিউন', গোখেল এর ‘সুধাকর’, কৃষ্ণ রাও ভালেকারের ‘দীনবন্ধু’, জি সি ভার্মার ‘হিন্দুস্তানি’ এবং ‘অ্যাডভোকেট অফ ইন্ডিয়া' প্রভৃতি।
• হিন্দুমেলা : 1867 খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্র ‘জাতীয় মেলা' প্রতিষ্ঠা করেন। 1870 খ্রিস্টাব্দে এর নাম হয় ‘হিন্দুমেলা’। হিন্দু মেলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন হিন্দু ধর্মের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার আদর্শে সবাইকে অনুপ্রাণিত করা। 1880 খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেলার অস্তিত্ব লোপ পায়। 1887 খ্রিস্টাব্দে স্বামী সত্যানন্দ অগ্নিহোত্রী ‘দেব সমাজ' গঠন করে আন্দোলন চালিয়ে যান।
• নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন : জাতীয়তাবাদের উন্মেষে নাটকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। 1876 খ্রিস্টাব্দে 19 ফেব্রুয়ারি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত ‘জগদানন্দ ও যুবরাজ' নামক প্রহসনমূলক নাটকটি অভিনয় পুলিশ বন্ধ করে দেয়। এরপর ‘হনুমান চরিত' নামে এটির অভিনয় পুনরায় শুরু হলে তাও নিষিদ্ধ হয়। 1876 খ্রিস্টাব্দে 4 ঠা মার্চ উপেন্দ্রনাথ দাস রচিত 'সুরেন্দ্র বিনোদিনী' নাটকের অভিনয় চলাকালীন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ঢুকে ম্যানেজার অমৃতলাল বসু, পরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস সহ মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করে। ‘শরৎ সরোজিনী' নামে আরেকটি নাটকের অভিনয়ও সরকার বন্ধ করে। প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়। লর্ড নর্থব্রুক 1876 খ্রিস্টাব্দে 14 ই মার্চ নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেন।
• সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন : 1878 খ্রিস্টাব্দে লর্ড লিটন ‘মাতৃ ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন' বা ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট' পাস করেন (1823 খ্রিস্টাব্দে লর্ড আমহার্স্ট একবার সংবাদপত্রের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন)। এই আইন বলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরন করা হয়।
• চাকরিতে বঞ্চনা : 1876 খ্রিস্টাব্দে এক আইন পাস করে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বয়স 21 থেকে কমিয়ে 19 করা হয়। 19 বছরের একজন ভারতীয় যুবকের পক্ষে লন্ডনে গিয়ে এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া এক রকম অসম্ভব ছিল। 1853 খ্রিস্টাব্দে প্রতিযোগিতামূলক সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। 1874 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সার্ভিসে ভারতীয়দের সংখ্যা ছিল মাত্র 5 জন। 1887 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের 900 টি পদের মধ্যে ভারতীয় ছিল মাত্র 16 জন।
• অর্থনৈতিক শোষণ : ইংরেজদের আর্থিক শোষণের ফলে 1865 থেকে 1880 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকটি ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। 1877 খ্রীষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষ প্রায় দু লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে 360 লক্ষ মানুষকে পিরিত করেছিল। এমতাবস্থায় আফগান যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য লড লিটন ভারতীয়দের উপর নতুন কর চাপান এবং ভারতীয় রাজস্ব থেকে কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করে মহারানী ভিক্টোরিয়ার সম্মানার্থে মহাসমারোহে দিল্লি দরবার অনুষ্ঠিত করেন। দাদাভাই নওরোজি তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'পভার্টি এন্ড আন-ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া', রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর 'ইকোনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া', এবং মহাদেব গোবিন্দ রানাডে 'ইন্ডিয়ান ইকনোমি' গ্রন্থ মারফত ইংরেজদের স্বৈরাচারী শাসনের স্বরূপ দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন।
• দেশাত্মবোধক সাহিত্যের বিকাশ : বাংলা সাহিত্যে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনাতেই সর্বপ্রথম জাতীয়তাবোধের স্ফুরণ দেখা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'তিলোত্তমা', 'শর্মিষ্ঠা', 'কৃষ্ণকুমারী' নাটক ও 'মেঘনাদবধ' কাব্য বাংলা সাহিত্যে এক নব যুগের সৃষ্টি করে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মিলে সব ভারত সন্তান', মনোমোহন বসুর 'দিনের দিন সবে দীন ভারত হয়ে পরাধীন', গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘লজ্জায় ভারত যশ গাহিব কি করে' প্রভৃতি সঙ্গীতগুলি স্বদেশী ভাবের উদ্বোধনে যথেষ্ট সাহায্য করে। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কর্মদেবী’, ‘শূরসুন্দরী’, ‘কাঞ্চীকাবেরী’, 'পদ্মিনী উপাখ্যান' প্রভৃতি কাব্য আত্মোৎসর্গে উদ্বুদ্ধ করে। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য, 'ভারত বিলাপ', 'ভারত ভিক্ষা', ‘ভারত সংগীত' এবং নবীনচন্দ্র সেনের ‘রৈবতক’, 'কুরুক্ষেত্র', ‘প্রভাস’ ও ‘পলাশীর যুদ্ধ' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য রচনা। রমেশ চন্দ্র দত্তের ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত' ও ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা' উপন্যাসের শিবাজীর নেতৃত্বে মুঘলদের বিরুদ্ধে মারাঠা এবং মোগলদের বিরুদ্ধে রাজপুতদের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। জাতীয়তাবাদের উন্মেষে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ধর্মতত্ত্ব’ ও' কৃষ্ণচরিত্র' গ্রন্থ এবং ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরানী' ও ‘সীতারাম’ উপন্যাস এর ভূমিকা অপরিসীম। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ তাকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ঋষি' এবং মনীষী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাকে 'The real Father of Indian Nationalism’ বা ‘স্বজাত্যবোধের আদ্যাচার্য' বলে অভিহিত করেছেন।
• নাটকের ভূমিকা : দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকে নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার ও দেশবাসীর সীমাহীন দুর্দশা চিত্র ফুটে উঠেছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ‘পুরুবিক্রম’, 'সরোজিনী', ‘অশ্রুমতি’ ও ‘স্বপ্নময়ী’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ', 'একেই কি বলে সভ্যতা', দক্ষিণাচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘চা কর দর্পণ', মীর মোশারফ হোসেন এর ‘জমিদার দর্পণ', উপেন্দ্রনাথ দাস এর ‘শরৎ সরোজিনী' ও ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী' অমৃতলাল বসুর ‘হীরকচূর্ণ’, ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ', গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সিরাজদৌলা’, 'মীরকাসিম', 'ছত্রপতি শিবাজী' এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘প্রতাপসিংহ’, ‘দুর্গাদাস’, ‘মেবার পতন', ‘শাজাহান’ প্রভৃতি নাটক দেশবাসীর মনে প্রবল স্বজাত্যবোধের জন্ম দেয়।
• সংবাদপত্রের ভূমিকা : জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য বাংলা সংবাদ পত্র গুলি হল – দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘সোমপ্রকাশ’ (নীলকরদের অত্যাচার ও সমকালীন রাজনীতি), ভূদেব মুখোপাধ্যায় এর ‘শিক্ষাদর্পণ' (জাতিবৈরিতা সম্পর্কিত রচনাবলী), অক্ষয় চন্দ্র সরকার এর ‘সাধারণী’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’, যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘আর্য দর্শন' (মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি ও ইতালির অন্যান্য বিপ্লবীদের জীবনী প্রকাশিত হতো), কেশবচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘সুলভ সমাচার', কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ। 1868 খ্রিস্টাব্দে শিশির কুমার ঘোষ সম্পাদিত ‘অমৃতবাজার পত্রিকা' প্রথমে যশোর থেকে প্রকাশিত হয় এবং 1872 খ্রিস্টাব্দে পত্রিকাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। 1878 খ্রিস্টাব্দে লর্ড লিটন ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন' প্রণয়ন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে উদ্যোগী হলে পত্রিকাটি ইংরেজি পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। 1853 খ্রিস্টাব্দে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট' জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। কিশোরী চাঁদ মিত্র সম্পাদিত ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড', মনমোহন ঘোষ সম্পাদিত ‘ইন্ডিয়ান মিরর', শম্ভু চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর ‘মুখার্জীস ম্যাগাজিন', গিরিশচন্দ্র ঘোষ সম্পাদিত ‘বেঙ্গলি’ এবং নবগোপাল মিত্রের ‘ন্যাশনাল পেপার' জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বিস্তারে বিশেষ স্থান অধিকার করে। বাংলার বাইরে ইংরেজি এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকার গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - মাদ্রাজের সুব্রক্ষ্মন্য আয়ারের ‘হিন্দু’ ও ‘স্বদেশমিত্রম’, বাল গঙ্গাধর তিলকের ‘কেশরী’ ও ‘মারাঠা’, দাদাভাই নওরোজির ‘দি ভয়েস অফ ইন্ডিয়া', পাঞ্জাবের সর্দার দয়াল সিং মাজিতিয়ার ‘লাহোর ট্রিবিউন', গোখেল এর ‘সুধাকর’, কৃষ্ণ রাও ভালেকারের ‘দীনবন্ধু’, জি সি ভার্মার ‘হিন্দুস্তানি’ এবং ‘অ্যাডভোকেট অফ ইন্ডিয়া' প্রভৃতি।
• হিন্দুমেলা : 1867 খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্র ‘জাতীয় মেলা' প্রতিষ্ঠা করেন। 1870 খ্রিস্টাব্দে এর নাম হয় ‘হিন্দুমেলা’। হিন্দু মেলার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন হিন্দু ধর্মের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার আদর্শে সবাইকে অনুপ্রাণিত করা। 1880 খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেলার অস্তিত্ব লোপ পায়। 1887 খ্রিস্টাব্দে স্বামী সত্যানন্দ অগ্নিহোত্রী ‘দেব সমাজ' গঠন করে আন্দোলন চালিয়ে যান।
• নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন : জাতীয়তাবাদের উন্মেষে নাটকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। 1876 খ্রিস্টাব্দে 19 ফেব্রুয়ারি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত ‘জগদানন্দ ও যুবরাজ' নামক প্রহসনমূলক নাটকটি অভিনয় পুলিশ বন্ধ করে দেয়। এরপর ‘হনুমান চরিত' নামে এটির অভিনয় পুনরায় শুরু হলে তাও নিষিদ্ধ হয়। 1876 খ্রিস্টাব্দে 4 ঠা মার্চ উপেন্দ্রনাথ দাস রচিত 'সুরেন্দ্র বিনোদিনী' নাটকের অভিনয় চলাকালীন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে ঢুকে ম্যানেজার অমৃতলাল বসু, পরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস সহ মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করে। ‘শরৎ সরোজিনী' নামে আরেকটি নাটকের অভিনয়ও সরকার বন্ধ করে। প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয়। লর্ড নর্থব্রুক 1876 খ্রিস্টাব্দে 14 ই মার্চ নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেন।
• সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন : 1878 খ্রিস্টাব্দে লর্ড লিটন ‘মাতৃ ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন' বা ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট' পাস করেন (1823 খ্রিস্টাব্দে লর্ড আমহার্স্ট একবার সংবাদপত্রের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন)। এই আইন বলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরন করা হয়।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.