• দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতীয় রাজনীতি : 1939 খ্রিস্টাব্দের 3রা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারত সরকার ভারতকে ‘যুদ্ধরত দেশ' বলে ঘোষণা করে। 1939 খ্রিস্টাব্দের 14ই সেপ্টেম্বর ‘কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতি' বৃটিশ সরকারকে গণতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা যুদ্ধ লক্ষ্য কি তা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে বলে এবং অবিলম্বে ভারতকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করতে বলে। 17ই অক্টোবর বড়লাট লিনলিথগো এক পত্র মারফত জানান, বৃটেনের যুদ্ধ লক্ষ্য সম্পর্কে তার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয় এবং যুদ্ধান্তে ভারতের বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন’ এর মর্যাদা দেওয়ার কথা তিনি বলেন। 1940 খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশনে ঘোষণা করা হয়, ডোমিনিয়নের মর্যাদা নয় পূর্ণ স্বাধীনতাই কংগ্রেসের লক্ষ্য। 1940 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস থেকে মিত্রপক্ষ পরাজিত হতে থাকে। জুন মাসে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজিকে একটি চিঠিতে জানান, আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার উপযুক্ত মুহূর্ত এখনই। গান্ধীজি বলতে থাকেন বৃটেনের ধ্বংসের মধ্যে ভারতের স্বাধীনতা অনুসন্ধান করা অহিংসা নীতির বিরোধী। 3 রা থেকে 7 ই জুলাই দিল্লিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতির বৈঠকে সহযোগিতার শর্ত হিসেবে, যুদ্ধান্তে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা এবং অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রে একটি সরকার গঠনের দাবি করা হয়। 27 ও 28 শে জুলাই কংগ্রেস কমিটির পুনা বৈঠকে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়।
• আগস্ট ঘোষণা : 1940 খ্রিস্টাব্দের 8ই আগস্ট বড়লাট লিনলিথগো প্রস্তাব দেন - যুদ্ধান্তে ভারতকে ডোমিনিয়ন এর মর্যাদা দেওয়া হবে, বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতিতে ভারতীয় সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে, ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যুদ্ধ উপদেষ্টা পর্ষদ গঠিত হবে এবং যুদ্ধান্তে ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠিত হবে এবং ব্রিটিশ সরকার এমন কোন ভারতীয় সরকার মেনে নেবে না যা ভারতীয় জনগণের একটি বৃহৎ অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কংগ্রেস আগস্ট ঘোষণা প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে।
• ক্রিপস মিশন : 1942 খ্রিস্টাব্দের 11 ই মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল যুদ্ধে ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা লাভ ও ভারতের সংবিধান সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলী নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস কে ভারতে পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন। 23 শে মার্চ ক্লিপস দিল্লীতে পৌঁছান। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার পর 23 শে মার্চ তিনি একটি প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাব ‘ক্রিপস প্রস্তাব' নামে খ্যাত। এই প্রস্তাবে বলা হয় - যুদ্ধান্তে ভারতকে ডোমিনিয়ন মর্যাদা দেওয়া হবে, ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠিত হবে, ভারতের কোন প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য ওই শাসনতন্ত্র গ্রহণে অনিচ্ছুক হলে তারা নিজেদের শাসনতন্ত্র রচনা করবে, সংবিধান সভার ব্রিটিশ ভারতের সদস্যগণ প্রাদেশিক আইনসভার নিম্ন কক্ষ দ্বারা ও দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা দেশীয় নৃপতিদের দ্বারা মনোনীত হবেন, সংবিধান তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীর উপর ব্রিটিশের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে। গান্ধীজি এই প্রস্তাবকে ‘ফেল-পড়া ব্যাংকের ওপর চেক কাটার সামিল' (“a post-dated cheque on a crashing Bank”) বলে আখ্যা করেন। কংগ্রেস ক্রিপসের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে। পাকিস্তানের কোন প্রতিশ্রুতি না থাকায় মুসলিম লীগ আপত্তি জানায়। কেবলমাত্র মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ‘রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি' একে স্বাগত জানায়। 1942 সালের 29 শে মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে ক্রিপস প্রস্তাবটি সর্বসমক্ষে পেশ করেন। 11ই এপ্রিল আর 1 একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন এবং পরদিনই লন্ডন যাত্রা করেন।
• ভারত ছাড় আন্দোলন : 1942 খ্রিস্টাব্দের 7 ই আগস্ট বোম্বাইয়ে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে বিপুল ভোটে ব্যাপক অহিংস আন্দোলন চালাবার প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং গান্ধীজি “করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে” এর ডাক দেন। 8 ই আগস্ট গভীর রাতে গান্ধীজি, জহরলাল নেহেরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল ও আজাদ সহ কংগ্রেসের অপরাপর নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। গান্ধীজীর ‘হরিজন পত্রিকা' সহ অন্যান্য কয়েকটি পত্রিকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। 9 আগস্ট সকালে জাতীয় নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত হলে দেশজোড়া স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল, বিক্ষোভ, মিছিল এবং বিক্ষিপ্ত গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়। মেদিনীপুরের তমলুক মহাকুমা ও কাঁথি মহাকুমার পটাশপুর ও খেজুরি থানা, দিনাজপুরের বালুরঘাট, মহারাষ্ট্রের সাতারা, আসামের নওগাঁ, ওড়িশার তালচের, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া ও আজমগড় প্রভৃতি স্থানে বিকল্প স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তমলুক বা ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের' সর্বাধিনায়ক ছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত। সাতারার দুই বিশিষ্ট নেতা হলেন নানা পাতিল ও শ্রীনাথ লাল। বালিয়াতে নেতৃত্ব দেন চৈতু পান্ডে, ঝাড়খন্ডে রায় ও সরযু পান্ডে। মেদিনীপুরের 73 বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা, আসামের 13 বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবের গৃহবধূ ভোগেশ্বরী ফুকোননি প্রমূখ বীরাঙ্গনা নারী এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সরকারি হিসেব থেকে জানা যায় এই আন্দোলনে 250 টি রেলস্টেশন ক্ষতিগ্রস্থ ও ধ্বংস হয়, 550 টি ডাকঘর আক্রান্ত হয়, 3500 টি জায়গায় টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের তার কেটে দেওয়া হয়, 70 টি থানা ও 85 টি অন্যান্য সরকারি গৃহ অগ্নিদগ্ধ হয়। পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর সাহায্যে এই আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করা হয়। সরকারি হিসেব থেকে জানা যায় পুলিশ 538 টি জায়গায় গুলি চালিয়ে 1028 জনকে হত্যা ও 3000 জনকে আহত করে। আন্দোলনে 60,229 জন বন্দী হয়। 1942 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই আগস্ট আন্দোলন গতি হারিয়ে ফেলে। মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা, অনুন্নত সম্প্রদায়, লিবারেল গোষ্ঠী এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে।
• ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ : 1941 খ্রিস্টাব্দের 7 ই ডিসেম্বর জাপান মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। 1942 খ্রিস্টাব্দের 15ই ফেব্রুয়ারি জাপানের হাতে সিঙ্গাপুরের পতন ঘটলে, প্রচুর ভারতীয় সৈন্য জাপানের হাতে বন্দী হয়। মোহন সিং এর নেতৃত্বে বন্দী সেনারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে রাজি হয়। তার চেষ্টায় প্রায় 40 হাজার বন্দি সেনা দলে যোগ দেয়। 1942 খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে রাসবিহারী বসুর সভাপতিত্বে ব্যাংককে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের এক সম্মেলনে ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ' গঠিত হয় এবং রাজবিহারী বসু তার সভাপতি হন। 1942 খ্রিস্টাব্দের 1 লা সেপ্টেম্বর রাসবিহারী বসু আনুষ্ঠানিকভাবে সিঙ্গাপুরে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ' গঠন করেন। প্রতিষ্ঠাকালে মোহন সিং ছিলেন এর প্রধান সেনাপতি।
• সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারত সরকার তার চরম শত্রু সুভাষচন্দ্র বসুকে 1940 খ্রিস্টাব্দের 2 রা জুলাই ‘ভারত রক্ষা আইনে' গ্রেফতার করে। 5ই ডিসেম্বর কারাগারে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাড়িতে পুলিশ পাহারায় গৃহবন্দী করা হয়। 1941 খ্রিস্টাব্দের 17 ই জানুয়ারি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি কলকাতা ত্যাগ করেন এবং কাবুলের মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়ায় পৌঁছান। এই সময় রুশ রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিন রাশিয়ার ওপর জার্মান আক্রমণের আশঙ্কায় ইংরেজদের মিত্রতা আশা করেন। রুশ সাহায্যের আশা ব্যর্থ হলে 28 শে মার্চ বিমানে করে তিনি জার্মানিতে উপস্থিত হন। তিনি জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুই রাষ্ট্রনায়কই তাকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। 1942 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বার্লিনে জার্মান সরকারের সহযোগিতায় ‘আজাদ হিন্দুস্তান' বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। 1942 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জার্মানির হাতে বন্দি 400 ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে তিনি এক সেনা দল গঠন করেন। জার্মানিতে বন্দী সেনাদল তাকে ‘নেতাজি’ আখ্যায় ভূষিত করে। 1943 খ্রিস্টাব্দের 13 ই জুন সুভাষচন্দ্র জার্মানি থেকে জাপানের রাজধানী টোকিওতে হাজির হন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাজো তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। 1943 খ্রিস্টাব্দের 4 ঠা জুলাই সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সভায় রাজবিহারী বসু সুভাষচন্দ্রের হাতে ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ' এর সকল দায়িত্ব অর্পণ করেন। 25 আগস্ট সুভাষচন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী’র নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এই সেনাদলে কয়েকটি ব্রিগেড বা বাহিনী ছিল - গান্ধী ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহেরু ব্রিগেড, শ্রীমতি লক্ষ্মী স্বামীনাথন এর নেতৃত্বে নারীদের নিয়ে গঠিত ঝাঁসির রানী ব্রিগেড, বালক-বালিকাদের নিয়ে গঠিত বাল সেনাদল এবং সুভাষ ব্রিগেড। শাহনওয়াজ খান, জি এস ধীলন ও পি কে সেগাল ছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর তিন সেনাধ্যক্ষ। 1943 খ্রিস্টাব্দের 21 শে অক্টোবর নেতাজি সিঙ্গাপুরে 'আজাদ হিন্দ সরকার' বা স্বাধীন ভারত সরকারের প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। 23 অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার বৃটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। 6 ই নভেম্বর জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাজো আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দুটি আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেন। 31 শে ডিসেম্বর নেতাজি এই দুটি দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখেন ‘শহীদ’ ও ‘স্বরাজ’ দ্বীপ। 1944 খ্রিস্টাব্দে 4ঠা জানুয়ারি নেতাজি রেঙ্গুনে আসেন এবং সেখানে তার প্রধান সামরিক দপ্তর স্থাপিত হয়। এরপর আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারত অভিযান শুরু করে। নেতাজি সেনাদলের সামনে “দিল্লি চলো” ধনী উত্থাপন করে। আজাদ হিন্দ বাহিনী মণিপুরে ঢুকে প্রায় 150 মাইল ভারতীয় এলাকা দখল করে। এই সময় আমেরিকা জাপানের দিকে অগ্রসর হয়। ফলে জাপানি বিমান-বহর ও সেনাবাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরের অভিমুখে প্রস্থান করলে বিমানের অভাবে আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রবল অসুবিধার সম্মুখীন হয়। সময়ের পূর্বেই বর্ষা নামায় খাদ্যাভাব, রোগ, শীত, ম্যালেরিয়া এবং পার্বত্য অঞ্চলের বিষাক্ত পোকার কামড়ে হাজার হাজার সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। 1945 খ্রিস্টাব্দের 15 ই আগস্ট জাপান মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে আজাদ হিন্দ ফৌজ অস্ত্র ত্যাগে বাধ্য হয়। কথিত আছে 1945 খ্রিস্টাব্দের 18 আগস্ট এক বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির জীবন অবসান ঘটে। এই কাহিনীর সত্যতা নিয়ে সকলে একমত নন। দিল্লির লাল কেল্লায় বন্দি সেনাদের বিচার শুরু হয়। প্রবল গণবিক্ষোভের ফলে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আজাদি সৈন্যদল মুক্তি পায়।
• নৌ বিদ্রোহ : ভারতীয় নৌবাহিনী কর্মীদের অখাদ্য সরবরাহ, অফিসারদের কুরুচিপূর্ণ ব্যবহার এবং ইংরেজ কর্মচারীদের সঙ্গে বেতন বৈষম্য ইত্যাদি কারণে 1946 খ্রিস্টাব্দের 18 ফেব্রুয়ারি বোম্বাইয়ের নৌপ্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘তলোয়ার’ জাহাজের 1500 নাবিক অখাদ্য আহার্য গ্রহণে অস্বীকৃত হয়। 19 শে ফেব্রুয়ারি তারা ইউনিয়ন জ্যাক (ব্রিটিশ পতাকা) নামিয়ে জাহাজে কংগ্রেস, লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির তিনটি পতাকা তুলে দেয় এবং ‘রয়াল ইন্ডিয়ান নেভি’র নাম রাখেন ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল নেভি'। ঐদিন ক্যাসাল ব্যারাকে বোম্বাইয়ের সমস্ত রণতরী এবং 19 টি বন্দরের 20 হাজার নাবিক ও কর্মী বিদ্রোহে যোগ দেয়। এই বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য ‘কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি' (“National Central strike comedy”) গঠিত হয় এবং এম এস খান তার সভাপতি নিযুক্ত হন। বিদ্রোহ মাদ্রাজ, কলকাতা, কোচিন, করাচি প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। নৌ সেনাপতি অ্যাডমিরাল গডফ্রে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন এবং স্থল বাহিনীকে কামান দাগার নির্দেশ দেন। মারাঠা সেনাবাহিনী সেই নির্দেশ অমান্য করে ব্যারাকে ফিরে যায়। 21শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাত ঘণ্টার লড়াইয়ে বোম্বাইয়ের রাজপথ রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই সময় বোম্বাই, পুনা ও অন্যান্য স্থানে বিমান বাহিনীর পাইলট ও কর্মীরা ধর্মঘট করেন। জব্বলপুরে ভারতীয় স্থল বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহীরা মনে করেছিল যে জাতীয় নেতৃবৃন্দ তাদের সাহায্য করবেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। বিদ্রোহীরা শ্রীমতি অরুনা আসফ আলির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বোম্বাই ত্যাগ করেন। জহরলাল, প্যাটেল, আজাদ বিদ্রোহীদের নিন্দা করেন। জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন এবং গান্ধীজি বলেন যে ইংরেজদের ব্যবহার অপছন্দ হলে নাবিকরা পদত্যাগ করতে পারেন। নৌ সেনাপতি গডফ্রে গোলা বর্ষণ করে বোম্বাই শহর ধ্বংসের হুমকি দিলে কংগ্রেস নেতা সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মধ্যস্থতায় বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে।
• ওয়াভেল পরিকল্পনা : 1945 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে জার্মানির পতনে ইউরোপে যুদ্ধের অবসান ঘটে কিন্তু এশিয়ায় জাপানের বিরুদ্ধে তখনও যুদ্ধ চলছিল ভারতের সামরিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে 1945 খ্রিস্টাব্দের 14 ই জুন বড়লাট ওয়াভেল কংগ্রেস ও লীগের কাছে একটি পরিকল্পনা পেশ করে এটি ওয়াভেল পরিকল্পনা নামে পরিচিত। এতে বলা হয় – শীঘ্রই সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর ও সংবিধান রচনার কাজ শুরু করবে, নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয়দের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে, বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতিতে একমাত্র বড়লাট ও প্রধান সেনাপতি ব্যতীত সকল সদস্যই ভারতীয় হবেন, কার্যনির্বাহক সমিতিতে বর্ণ হিন্দু ও মুসলিমদের অনুপাত সমান হবে এবং ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব যতদিন ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে ততদিন সামরিক দপ্তর ব্রিটিশ সরকারের হাতে থাকবে।
• সিমলা বৈঠক : এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য লর্ড ওয়াভেল 1945 খ্রীষ্টাব্দের 25 শে জুন সিমলায় এক সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করেন। 15 জুন এই উদ্দেশ্যে কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতির বন্দী সদস্যদের মুক্তি দেওয়া হয়। জিন্না এই বৈঠকে পাকিস্তানের দাবি করেন এবং বলেন বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতিতে নিযুক্ত মুসলিম সদস্যরা একমাত্র লীগ কর্তৃক মনোনীত হবেন। কংগ্রেস এই দাবি মেনে নেয়নি ফলে সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হয়।
• ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব : 1945 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ব্রিটেনে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে শ্রমিকদল জয়যুক্ত হয়। এই দল ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। 1945 খ্রিস্টাব্দের 4ঠা ডিসেম্বর ভারত সচিব স্যার পেথিক লরেন্স হাউস অব লর্ডস-এ ঘোষণা করেন যে, ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত ব্যাপারে আলোচনার জন্য শীঘ্রই পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধি দল ভারতে পাঠানো হবে। 1946 খ্রিষ্টাব্দের 19 শে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ যেদিন ভারতে নৌ বিদ্রোহ শুরু হয় সেদিনই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পুনরায় ঘোষণা করেন যে, ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য ভারতে একটি মন্ত্রী মিশন পাঠানো হবে।
• মন্ত্রী মিশন : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলির মন্ত্রিসভার সদস্য স্টাফোর্ড ক্রিপস, এ ভি আলেকজান্ডার এবং প্যাথিক লরেন্স কে নিয়ে গঠিত হয় ‘মন্ত্রী মিশন' বা ‘ক্যাবিনেট মিশন'। 1946 খ্রিস্টাব্দে 24 মার্চ এই মিশন দিল্লিতে আসে। এর পরিকল্পনায় বলা হয় – ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও আঞ্চলিক রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে, ভারতের হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশ গুলি করে, মুসলিম প্রদেশ গুলি খ এবং বাংলা ও আসাম প্রদেশ কে গ শ্রেণীভূক্ত করা হবে, এই প্রদেশ গুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠিত হবে, সাম্প্রদায়িক নীতির ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠন ও প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচন হবে, কোন প্রদেশ ইচ্ছা করলে নতুন সংবিধান রচনা করতে পারবে এবং সংবিধান রচনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের অস্তিত্ব থাকবে।
• লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম : মন্ত্রী মিশন এর পরিকল্পনায় পাকিস্তানের কোন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত না থাকায় মুসলিম লীগ 1946 খ্রিস্টাব্দের 16 ই আগস্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়।
• অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : 1946 খ্রিস্টাব্দের 2 রা সেপ্টম্বর জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে কেন্দ্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, অরুনা আসফ আলি, জগজ্জীবন রাম, শরৎচন্দ্র বসু প্রমুখ কংগ্রেস সদস্যরা এই সরকারে যোগ দেন। মুসলিম লীগ প্রথমে এই সরকারে যোগদান না করলেও পরে বড়লাট ওয়াভেলের অনুরোধে লীগের পাঁচজন সদস্য লিয়াকত আলী খাঁ, চুন্দ্রীগড়, আবদুর রব নিস্তার, গজনফর আলি খাঁ ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল এই সরকারে যোগদান করেন। তাদের ক্রমাগত বাধার ফলে কংগ্রেস স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে পারেনি।
• এটলির ঘোষণা : 1947 খ্রিষ্টাব্দের 20 শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইটলি ঘোষণা করেন যে 1948 খ্রিস্টাব্দের জুন এর পূর্বেই দায়িত্বশীল ভারতীয় নেতৃবৃন্দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা হবে। এই ঘোষণার পর লীগ পাঞ্জাব ও আসামে পুনরায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করে।
• মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণা : লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন 1947 খ্রিষ্টাব্দের 24 শে মার্চ দাঙ্গা বিধ্বস্ত ভারতের বড়লাট হয়ে এদেশে এসেই তার প্রধান উপদেষ্টা ভি পি মেনন -এর সহযোগিতায় 3 জুন ভারত বিভাগের খসড়া পত্রটি প্রকাশ করেন। পরের দিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে মাউন্টব্যাটেন জানান ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। 1947 খ্রিস্টাব্দে 15 ই আগস্টের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। মাউন্টব্যাটেনের এই সিদ্ধান্ত ও ঘোষণাপত্রটি ‘মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব' বা ‘রোয়েদাদ’ (‘Mountbatten award') নামে পরিচিত।
• ভারতের স্বাধীনতা আইন : মাউন্টব্যাটেন এর প্রস্তাব 1947 খ্রিষ্টাব্দের 4 জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাঠানো হয়। 1947 খ্রিষ্টাব্দের 18 জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন (‘Indian Independence Act of 1947') পাশ হয়।
• ভারতের স্বাধীনতা : ভারত শাসন আইনের বলে লর্ড মাউন্টব্যাটেন 14 ই আগষ্ট উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, সিন্ধু, পশ্চিম পাঞ্জাব ও আসামের শ্রী হট্ট সহ সমগ্র পূর্ববঙ্গ নিয়ে পাকিস্তান ডোমিনিয়ন গঠন করেন। ওই দিন মধ্যরাত্রে ভারত ডোমিনিয়ন এর জন্ম হয়। সরকার সমস্ত ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে হস্তান্তর করে দীর্ঘ 200 বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটান। 15ই আগস্ট থেকে ভারত ও পাকিস্তান দুটি পৃথক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়।
• আগস্ট ঘোষণা : 1940 খ্রিস্টাব্দের 8ই আগস্ট বড়লাট লিনলিথগো প্রস্তাব দেন - যুদ্ধান্তে ভারতকে ডোমিনিয়ন এর মর্যাদা দেওয়া হবে, বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতিতে ভারতীয় সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে, ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যুদ্ধ উপদেষ্টা পর্ষদ গঠিত হবে এবং যুদ্ধান্তে ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠিত হবে এবং ব্রিটিশ সরকার এমন কোন ভারতীয় সরকার মেনে নেবে না যা ভারতীয় জনগণের একটি বৃহৎ অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কংগ্রেস আগস্ট ঘোষণা প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে।
• ক্রিপস মিশন : 1942 খ্রিস্টাব্দের 11 ই মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল যুদ্ধে ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা লাভ ও ভারতের সংবিধান সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলী নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য স্যার স্টাফোর্ড ক্রিপস কে ভারতে পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন। 23 শে মার্চ ক্লিপস দিল্লীতে পৌঁছান। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার পর 23 শে মার্চ তিনি একটি প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাব ‘ক্রিপস প্রস্তাব' নামে খ্যাত। এই প্রস্তাবে বলা হয় - যুদ্ধান্তে ভারতকে ডোমিনিয়ন মর্যাদা দেওয়া হবে, ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গঠিত হবে, ভারতের কোন প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য ওই শাসনতন্ত্র গ্রহণে অনিচ্ছুক হলে তারা নিজেদের শাসনতন্ত্র রচনা করবে, সংবিধান সভার ব্রিটিশ ভারতের সদস্যগণ প্রাদেশিক আইনসভার নিম্ন কক্ষ দ্বারা ও দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা দেশীয় নৃপতিদের দ্বারা মনোনীত হবেন, সংবিধান তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীর উপর ব্রিটিশের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে। গান্ধীজি এই প্রস্তাবকে ‘ফেল-পড়া ব্যাংকের ওপর চেক কাটার সামিল' (“a post-dated cheque on a crashing Bank”) বলে আখ্যা করেন। কংগ্রেস ক্রিপসের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে। পাকিস্তানের কোন প্রতিশ্রুতি না থাকায় মুসলিম লীগ আপত্তি জানায়। কেবলমাত্র মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ‘রেডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি' একে স্বাগত জানায়। 1942 সালের 29 শে মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে ক্রিপস প্রস্তাবটি সর্বসমক্ষে পেশ করেন। 11ই এপ্রিল আর 1 একটি সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন এবং পরদিনই লন্ডন যাত্রা করেন।
• ভারত ছাড় আন্দোলন : 1942 খ্রিস্টাব্দের 7 ই আগস্ট বোম্বাইয়ে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে বিপুল ভোটে ব্যাপক অহিংস আন্দোলন চালাবার প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং গান্ধীজি “করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে” এর ডাক দেন। 8 ই আগস্ট গভীর রাতে গান্ধীজি, জহরলাল নেহেরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল ও আজাদ সহ কংগ্রেসের অপরাপর নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। গান্ধীজীর ‘হরিজন পত্রিকা' সহ অন্যান্য কয়েকটি পত্রিকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। 9 আগস্ট সকালে জাতীয় নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত হলে দেশজোড়া স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল, বিক্ষোভ, মিছিল এবং বিক্ষিপ্ত গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়। মেদিনীপুরের তমলুক মহাকুমা ও কাঁথি মহাকুমার পটাশপুর ও খেজুরি থানা, দিনাজপুরের বালুরঘাট, মহারাষ্ট্রের সাতারা, আসামের নওগাঁ, ওড়িশার তালচের, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া ও আজমগড় প্রভৃতি স্থানে বিকল্প স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তমলুক বা ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের' সর্বাধিনায়ক ছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত। সাতারার দুই বিশিষ্ট নেতা হলেন নানা পাতিল ও শ্রীনাথ লাল। বালিয়াতে নেতৃত্ব দেন চৈতু পান্ডে, ঝাড়খন্ডে রায় ও সরযু পান্ডে। মেদিনীপুরের 73 বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা, আসামের 13 বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবের গৃহবধূ ভোগেশ্বরী ফুকোননি প্রমূখ বীরাঙ্গনা নারী এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সরকারি হিসেব থেকে জানা যায় এই আন্দোলনে 250 টি রেলস্টেশন ক্ষতিগ্রস্থ ও ধ্বংস হয়, 550 টি ডাকঘর আক্রান্ত হয়, 3500 টি জায়গায় টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের তার কেটে দেওয়া হয়, 70 টি থানা ও 85 টি অন্যান্য সরকারি গৃহ অগ্নিদগ্ধ হয়। পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর সাহায্যে এই আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করা হয়। সরকারি হিসেব থেকে জানা যায় পুলিশ 538 টি জায়গায় গুলি চালিয়ে 1028 জনকে হত্যা ও 3000 জনকে আহত করে। আন্দোলনে 60,229 জন বন্দী হয়। 1942 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই আগস্ট আন্দোলন গতি হারিয়ে ফেলে। মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা, অনুন্নত সম্প্রদায়, লিবারেল গোষ্ঠী এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে।
• ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ : 1941 খ্রিস্টাব্দের 7 ই ডিসেম্বর জাপান মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। 1942 খ্রিস্টাব্দের 15ই ফেব্রুয়ারি জাপানের হাতে সিঙ্গাপুরের পতন ঘটলে, প্রচুর ভারতীয় সৈন্য জাপানের হাতে বন্দী হয়। মোহন সিং এর নেতৃত্বে বন্দী সেনারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে রাজি হয়। তার চেষ্টায় প্রায় 40 হাজার বন্দি সেনা দলে যোগ দেয়। 1942 খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে রাসবিহারী বসুর সভাপতিত্বে ব্যাংককে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের এক সম্মেলনে ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ' গঠিত হয় এবং রাজবিহারী বসু তার সভাপতি হন। 1942 খ্রিস্টাব্দের 1 লা সেপ্টেম্বর রাসবিহারী বসু আনুষ্ঠানিকভাবে সিঙ্গাপুরে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ' গঠন করেন। প্রতিষ্ঠাকালে মোহন সিং ছিলেন এর প্রধান সেনাপতি।
• সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারত সরকার তার চরম শত্রু সুভাষচন্দ্র বসুকে 1940 খ্রিস্টাব্দের 2 রা জুলাই ‘ভারত রক্ষা আইনে' গ্রেফতার করে। 5ই ডিসেম্বর কারাগারে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাড়িতে পুলিশ পাহারায় গৃহবন্দী করা হয়। 1941 খ্রিস্টাব্দের 17 ই জানুয়ারি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি কলকাতা ত্যাগ করেন এবং কাবুলের মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়ায় পৌঁছান। এই সময় রুশ রাষ্ট্রপ্রধান স্ট্যালিন রাশিয়ার ওপর জার্মান আক্রমণের আশঙ্কায় ইংরেজদের মিত্রতা আশা করেন। রুশ সাহায্যের আশা ব্যর্থ হলে 28 শে মার্চ বিমানে করে তিনি জার্মানিতে উপস্থিত হন। তিনি জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুই রাষ্ট্রনায়কই তাকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। 1942 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বার্লিনে জার্মান সরকারের সহযোগিতায় ‘আজাদ হিন্দুস্তান' বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। 1942 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জার্মানির হাতে বন্দি 400 ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে তিনি এক সেনা দল গঠন করেন। জার্মানিতে বন্দী সেনাদল তাকে ‘নেতাজি’ আখ্যায় ভূষিত করে। 1943 খ্রিস্টাব্দের 13 ই জুন সুভাষচন্দ্র জার্মানি থেকে জাপানের রাজধানী টোকিওতে হাজির হন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাজো তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। 1943 খ্রিস্টাব্দের 4 ঠা জুলাই সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক বিশাল সভায় রাজবিহারী বসু সুভাষচন্দ্রের হাতে ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ' এর সকল দায়িত্ব অর্পণ করেন। 25 আগস্ট সুভাষচন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আজাদ হিন্দ বাহিনী’র নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এই সেনাদলে কয়েকটি ব্রিগেড বা বাহিনী ছিল - গান্ধী ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহেরু ব্রিগেড, শ্রীমতি লক্ষ্মী স্বামীনাথন এর নেতৃত্বে নারীদের নিয়ে গঠিত ঝাঁসির রানী ব্রিগেড, বালক-বালিকাদের নিয়ে গঠিত বাল সেনাদল এবং সুভাষ ব্রিগেড। শাহনওয়াজ খান, জি এস ধীলন ও পি কে সেগাল ছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর তিন সেনাধ্যক্ষ। 1943 খ্রিস্টাব্দের 21 শে অক্টোবর নেতাজি সিঙ্গাপুরে 'আজাদ হিন্দ সরকার' বা স্বাধীন ভারত সরকারের প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। 23 অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার বৃটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। 6 ই নভেম্বর জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাজো আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দুটি আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেন। 31 শে ডিসেম্বর নেতাজি এই দুটি দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখেন ‘শহীদ’ ও ‘স্বরাজ’ দ্বীপ। 1944 খ্রিস্টাব্দে 4ঠা জানুয়ারি নেতাজি রেঙ্গুনে আসেন এবং সেখানে তার প্রধান সামরিক দপ্তর স্থাপিত হয়। এরপর আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারত অভিযান শুরু করে। নেতাজি সেনাদলের সামনে “দিল্লি চলো” ধনী উত্থাপন করে। আজাদ হিন্দ বাহিনী মণিপুরে ঢুকে প্রায় 150 মাইল ভারতীয় এলাকা দখল করে। এই সময় আমেরিকা জাপানের দিকে অগ্রসর হয়। ফলে জাপানি বিমান-বহর ও সেনাবাহিনী প্রশান্ত মহাসাগরের অভিমুখে প্রস্থান করলে বিমানের অভাবে আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রবল অসুবিধার সম্মুখীন হয়। সময়ের পূর্বেই বর্ষা নামায় খাদ্যাভাব, রোগ, শীত, ম্যালেরিয়া এবং পার্বত্য অঞ্চলের বিষাক্ত পোকার কামড়ে হাজার হাজার সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। 1945 খ্রিস্টাব্দের 15 ই আগস্ট জাপান মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে আজাদ হিন্দ ফৌজ অস্ত্র ত্যাগে বাধ্য হয়। কথিত আছে 1945 খ্রিস্টাব্দের 18 আগস্ট এক বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির জীবন অবসান ঘটে। এই কাহিনীর সত্যতা নিয়ে সকলে একমত নন। দিল্লির লাল কেল্লায় বন্দি সেনাদের বিচার শুরু হয়। প্রবল গণবিক্ষোভের ফলে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আজাদি সৈন্যদল মুক্তি পায়।
• নৌ বিদ্রোহ : ভারতীয় নৌবাহিনী কর্মীদের অখাদ্য সরবরাহ, অফিসারদের কুরুচিপূর্ণ ব্যবহার এবং ইংরেজ কর্মচারীদের সঙ্গে বেতন বৈষম্য ইত্যাদি কারণে 1946 খ্রিস্টাব্দের 18 ফেব্রুয়ারি বোম্বাইয়ের নৌপ্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘তলোয়ার’ জাহাজের 1500 নাবিক অখাদ্য আহার্য গ্রহণে অস্বীকৃত হয়। 19 শে ফেব্রুয়ারি তারা ইউনিয়ন জ্যাক (ব্রিটিশ পতাকা) নামিয়ে জাহাজে কংগ্রেস, লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির তিনটি পতাকা তুলে দেয় এবং ‘রয়াল ইন্ডিয়ান নেভি’র নাম রাখেন ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল নেভি'। ঐদিন ক্যাসাল ব্যারাকে বোম্বাইয়ের সমস্ত রণতরী এবং 19 টি বন্দরের 20 হাজার নাবিক ও কর্মী বিদ্রোহে যোগ দেয়। এই বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য ‘কেন্দ্রীয় ধর্মঘট কমিটি' (“National Central strike comedy”) গঠিত হয় এবং এম এস খান তার সভাপতি নিযুক্ত হন। বিদ্রোহ মাদ্রাজ, কলকাতা, কোচিন, করাচি প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। নৌ সেনাপতি অ্যাডমিরাল গডফ্রে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন এবং স্থল বাহিনীকে কামান দাগার নির্দেশ দেন। মারাঠা সেনাবাহিনী সেই নির্দেশ অমান্য করে ব্যারাকে ফিরে যায়। 21শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাত ঘণ্টার লড়াইয়ে বোম্বাইয়ের রাজপথ রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই সময় বোম্বাই, পুনা ও অন্যান্য স্থানে বিমান বাহিনীর পাইলট ও কর্মীরা ধর্মঘট করেন। জব্বলপুরে ভারতীয় স্থল বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহীরা মনে করেছিল যে জাতীয় নেতৃবৃন্দ তাদের সাহায্য করবেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। বিদ্রোহীরা শ্রীমতি অরুনা আসফ আলির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বোম্বাই ত্যাগ করেন। জহরলাল, প্যাটেল, আজাদ বিদ্রোহীদের নিন্দা করেন। জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন এবং গান্ধীজি বলেন যে ইংরেজদের ব্যবহার অপছন্দ হলে নাবিকরা পদত্যাগ করতে পারেন। নৌ সেনাপতি গডফ্রে গোলা বর্ষণ করে বোম্বাই শহর ধ্বংসের হুমকি দিলে কংগ্রেস নেতা সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মধ্যস্থতায় বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে।
• ওয়াভেল পরিকল্পনা : 1945 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে জার্মানির পতনে ইউরোপে যুদ্ধের অবসান ঘটে কিন্তু এশিয়ায় জাপানের বিরুদ্ধে তখনও যুদ্ধ চলছিল ভারতের সামরিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে 1945 খ্রিস্টাব্দের 14 ই জুন বড়লাট ওয়াভেল কংগ্রেস ও লীগের কাছে একটি পরিকল্পনা পেশ করে এটি ওয়াভেল পরিকল্পনা নামে পরিচিত। এতে বলা হয় – শীঘ্রই সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর ও সংবিধান রচনার কাজ শুরু করবে, নতুন সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয়দের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে, বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতিতে একমাত্র বড়লাট ও প্রধান সেনাপতি ব্যতীত সকল সদস্যই ভারতীয় হবেন, কার্যনির্বাহক সমিতিতে বর্ণ হিন্দু ও মুসলিমদের অনুপাত সমান হবে এবং ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব যতদিন ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে ততদিন সামরিক দপ্তর ব্রিটিশ সরকারের হাতে থাকবে।
• সিমলা বৈঠক : এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য লর্ড ওয়াভেল 1945 খ্রীষ্টাব্দের 25 শে জুন সিমলায় এক সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করেন। 15 জুন এই উদ্দেশ্যে কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতির বন্দী সদস্যদের মুক্তি দেওয়া হয়। জিন্না এই বৈঠকে পাকিস্তানের দাবি করেন এবং বলেন বড়লাটের কার্যনির্বাহক সমিতিতে নিযুক্ত মুসলিম সদস্যরা একমাত্র লীগ কর্তৃক মনোনীত হবেন। কংগ্রেস এই দাবি মেনে নেয়নি ফলে সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হয়।
• ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব : 1945 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ব্রিটেনে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে শ্রমিকদল জয়যুক্ত হয়। এই দল ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। 1945 খ্রিস্টাব্দের 4ঠা ডিসেম্বর ভারত সচিব স্যার পেথিক লরেন্স হাউস অব লর্ডস-এ ঘোষণা করেন যে, ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত ব্যাপারে আলোচনার জন্য শীঘ্রই পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধি দল ভারতে পাঠানো হবে। 1946 খ্রিষ্টাব্দের 19 শে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ যেদিন ভারতে নৌ বিদ্রোহ শুরু হয় সেদিনই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পুনরায় ঘোষণা করেন যে, ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য ভারতে একটি মন্ত্রী মিশন পাঠানো হবে।
• মন্ত্রী মিশন : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলির মন্ত্রিসভার সদস্য স্টাফোর্ড ক্রিপস, এ ভি আলেকজান্ডার এবং প্যাথিক লরেন্স কে নিয়ে গঠিত হয় ‘মন্ত্রী মিশন' বা ‘ক্যাবিনেট মিশন'। 1946 খ্রিস্টাব্দে 24 মার্চ এই মিশন দিল্লিতে আসে। এর পরিকল্পনায় বলা হয় – ব্রিটিশ শাসিত ভারত ও আঞ্চলিক রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে, ভারতের হিন্দু অধ্যুষিত প্রদেশ গুলি করে, মুসলিম প্রদেশ গুলি খ এবং বাংলা ও আসাম প্রদেশ কে গ শ্রেণীভূক্ত করা হবে, এই প্রদেশ গুলির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠিত হবে, সাম্প্রদায়িক নীতির ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠন ও প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচন হবে, কোন প্রদেশ ইচ্ছা করলে নতুন সংবিধান রচনা করতে পারবে এবং সংবিধান রচনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের অস্তিত্ব থাকবে।
• লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম : মন্ত্রী মিশন এর পরিকল্পনায় পাকিস্তানের কোন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত না থাকায় মুসলিম লীগ 1946 খ্রিস্টাব্দের 16 ই আগস্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়।
• অন্তর্বর্তীকালীন সরকার : 1946 খ্রিস্টাব্দের 2 রা সেপ্টম্বর জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে কেন্দ্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, অরুনা আসফ আলি, জগজ্জীবন রাম, শরৎচন্দ্র বসু প্রমুখ কংগ্রেস সদস্যরা এই সরকারে যোগ দেন। মুসলিম লীগ প্রথমে এই সরকারে যোগদান না করলেও পরে বড়লাট ওয়াভেলের অনুরোধে লীগের পাঁচজন সদস্য লিয়াকত আলী খাঁ, চুন্দ্রীগড়, আবদুর রব নিস্তার, গজনফর আলি খাঁ ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল এই সরকারে যোগদান করেন। তাদের ক্রমাগত বাধার ফলে কংগ্রেস স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে পারেনি।
• এটলির ঘোষণা : 1947 খ্রিষ্টাব্দের 20 শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইটলি ঘোষণা করেন যে 1948 খ্রিস্টাব্দের জুন এর পূর্বেই দায়িত্বশীল ভারতীয় নেতৃবৃন্দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা হবে। এই ঘোষণার পর লীগ পাঞ্জাব ও আসামে পুনরায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করে।
• মাউন্টব্যাটেনের ঘোষণা : লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন 1947 খ্রিষ্টাব্দের 24 শে মার্চ দাঙ্গা বিধ্বস্ত ভারতের বড়লাট হয়ে এদেশে এসেই তার প্রধান উপদেষ্টা ভি পি মেনন -এর সহযোগিতায় 3 জুন ভারত বিভাগের খসড়া পত্রটি প্রকাশ করেন। পরের দিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে মাউন্টব্যাটেন জানান ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে। 1947 খ্রিস্টাব্দে 15 ই আগস্টের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। মাউন্টব্যাটেনের এই সিদ্ধান্ত ও ঘোষণাপত্রটি ‘মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব' বা ‘রোয়েদাদ’ (‘Mountbatten award') নামে পরিচিত।
• ভারতের স্বাধীনতা আইন : মাউন্টব্যাটেন এর প্রস্তাব 1947 খ্রিষ্টাব্দের 4 জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাঠানো হয়। 1947 খ্রিষ্টাব্দের 18 জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন (‘Indian Independence Act of 1947') পাশ হয়।
• ভারতের স্বাধীনতা : ভারত শাসন আইনের বলে লর্ড মাউন্টব্যাটেন 14 ই আগষ্ট উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, সিন্ধু, পশ্চিম পাঞ্জাব ও আসামের শ্রী হট্ট সহ সমগ্র পূর্ববঙ্গ নিয়ে পাকিস্তান ডোমিনিয়ন গঠন করেন। ওই দিন মধ্যরাত্রে ভারত ডোমিনিয়ন এর জন্ম হয়। সরকার সমস্ত ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে হস্তান্তর করে দীর্ঘ 200 বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটান। 15ই আগস্ট থেকে ভারত ও পাকিস্তান দুটি পৃথক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.