ইংরেজ রাজত্ব কালে ভারতের অর্থনৈতিক বিবর্তন || Economic evolution of India during the British rule


রেলপথের বিকাশ : লর্ড ডালহৌসি কে ভারতীয় রেলপথের জনক বলা হয়। তার শাসনকালে 1853 খ্রিস্টাব্দে 'গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেল কোম্পানি' (G. I. P. R.) সর্বপ্রথম বোম্বাই থেকে থানা (বর্তমান থানে) পর্যন্ত 21 মাইল পথ রেল যোগাযোগ স্থাপন করে। 1854 খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কোম্পানি’ (E.I.R.) হাওড়া থেকে পান্ডুয়া এবং 1855 খ্রিস্টাব্দে হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপিত করে। 1870 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই ও কলকাতা এবং 1871 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই ও মাদ্রাজের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

গ্যারান্টি ব্যবস্থা : প্রথম দিকে ভারতে রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব কয়েকটি ব্রিটিশ কোম্পানিকে দেওয়া হয়। তারা মনে করেছিল যে ভারতে রেল ব্যবস্থা লাভজনক হবে না এবং এই কাজে তারা উৎসাহী ছিল না। এই কারণে তাদের কয়েকটি বিষয়ে গ্যারান্টি বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা ‘গ্যারান্টি ব্যবস্থা' নামে পরিচিত। 1849 খ্রিস্টাব্দে এই ব্যবস্থা চালু হয় এবং 1869 খ্রিস্টাব্দে এই ব্যবস্থা বাতিল হয়। 1880 খ্রিস্টাব্দে পুনরায় গ্যারান্টি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, কিন্তু রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ থাকে সরকারি হাতে। এই সময় 5 শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে তিন শতাংশ সুদের গ্যারান্টি দেওয়া হয়। 1905 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রেল ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ‘রেল বোর্ড' গঠিত হয়। রেলপথের সম্প্রসারণ ও রেল প্রশাসন সংস্কারের উদ্দেশ্যে 1919 খ্রিস্টাব্দে স্যার উইলিয়াম অ্যাকওয়ার্থ এর সভাপতিত্বে ‘অ্যাকওয়ার্থ কমিটি' নামে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি নিযুক্ত হয়।

ইউরোপীয় শিল্পোদ্যোগ : 1839 খ্রিস্টাব্দে কিছু ইংরেজ বণিক আসাম টি কোম্পানি গঠন করে চা শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করে। ক্রমে আসাম, বাংলা, কাছাড়, তরাই অঞ্চল, ডুয়ার্স, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাবের কাংরা, দক্ষিণ ভারত ও নীলগিরি অঞ্চলে চা শিল্প প্রসার লাভ করে। 1823 খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে প্রথম কফি চাষ শুরু হয়। বাংলায় সুবিধাজনক না হওয়ায় দক্ষিণ ভারতের মহীশূর ও নীলগিরিতে এই চাষ শুরু করা হয়। 1855 খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জনৈক প্রাক্তন কর্মচারী জর্জ অকল্যান্ড কলকাতার নিকটবর্তী রিষড়ায় প্রথম পাটকল স্থাপন করেন। 1884 খ্রিস্টাব্দে চটকল মালিকদের সমিতি ‘ইন্ডিয়ান জুট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন' প্রতিষ্ঠিত হয় এবং 1902 খ্রিস্টাব্দে এর নাম হয় ‘ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন'। 1800 কোটি খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ এর কাছে উল্টো ন ভোতে প্রথম লৌহ ও ইস্পাত কারখানা স্থাপিত হয়। ব্রিটিশ উদ্যোগে 1874 খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল আয়রন ওয়ার্কস কম্পানি', 1889 খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল আয়রন এন্ড ষ্টীল কম্পানি', 1918 খ্রিস্টাব্দে ‘ইন্ডিয়ান আয়রন এন্ড ষ্টীল কোম্পানি' প্রতিষ্ঠিত হয়। 1814 খ্রিস্টাব্দে রানীগঞ্জে সর্ব প্রথম কয়লা আবিষ্কৃত হয়। সামরিক ও রেল কর্মচারীদের শীতকালীন পোশাক সরবরাহের জন্য সরকারি উদ্যোগে কানপুর ও ব্যাঙ্গালোরে আধুনিক পশম কারখানা গড়ে ওঠে। সেনাবাহিনীর বুট সরবরাহের জন্য কানপুরে 1860 খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় ‘হার্নেস এন্ড স্যাডলারি ফ্যাক্টরি'।

ভারতীয় শিল্পোদ্যোগ : 1853 খ্রিস্টাব্দে পারসি শিল্পপতি কাউয়াসজি নানাভাই দাভর বোম্বাইয়ে সর্বপ্রথম একটি কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠা করেন। 1859 খ্রিস্টাব্দে রণছোড়লাল ছেপটলাল আমেদাবাদে একটি কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠা করেন। 1887 খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট ভারতীয় শিল্পপতি জামসেদজী টাটা নাগপুরে ‘এম্প্রেস মিল' প্রতিষ্ঠা করেন। 1879 খ্রিস্টাব্দে ভারতে মোট সুতি বস্ত্রের কল ছিল 56 টি। 1905 খ্রিস্টাব্দে তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় 206 টিতে। 1913 খ্রিস্টাব্দে বস্ত্র রপ্তানিতে ভারত ছিল বৃটেনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে। 1878 খ্রিস্টাব্দে জয়চাঁদ সান্যাল ‘জলপাইগুড়ি টি কোম্পানি' প্রতিষ্ঠা করেন। 1892 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কলকাতায় ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাকিউটিক্যাল ওয়ার্কস' প্রতিষ্ঠা করেন। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দ্বারকানাথ ঠাকুরের ‘কার, টেগর এন্ড কম্পানি' কয়লা খনিতে মূলধন বিনিয়োগ করে। 1867 খ্রিস্টাব্দে কিশোরীলাল মুখোপাধ্যায় হাওড়ার শিবপুরে একটি লৌহ কারখানা স্থাপন করেন। 1892 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন ও বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার রাজেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় যৌথভাবে ‘মার্টিন এন্ড কোম্পানি' প্রতিষ্ঠা করে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। নওয়াল কিশোর নামে জনৈক ব্যবসায়ী লখনৌ-এ ‘লখনৌ আয়রন এন্ড ষ্টীল কোম্পানি' প্রতিষ্ঠা করেন। 1907 খ্রিস্টাব্দে পারসি শিল্পপতি জামসেদজী টাটা জামশেদপুরে ‘টাটা আয়রন এন্ড ষ্টীল কোম্পানি' (TISCI) প্রতিষ্ঠা করেন। 1919 খ্রিস্টাব্দে ‘ইন্ডিয়ান আয়রন এন্ড ষ্টীল কোম্পানি' প্রতিষ্ঠিত হয়।

শিল্প কমিশন : 1916 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় শিল্পের প্রসার ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ভারতীয় মূলধন বিনিয়োগের সম্ভাবনা বিচার করার জন্য ভারত সরকার স্যার টমাস হল্যান্ড এর নেতৃত্বে একটি ‘শিল্প কমিশন' নিয়োগ করে।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Advertisement