• মহাত্মা গান্ধী : 1869 খ্রিস্টাব্দে 2রা অক্টোবর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী গুজরাটের পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। 1891 খ্রিস্টাব্দে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। 1892 খ্রিস্টাব্দে আইন ব্যবসার জন্য তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালে যাত্রা করেন। সেই সময় জীবিকার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় 10 হাজার ভারতীয় শ্রমিকের বসবাস ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার বর্ণ বিদ্বেষের কারণে তাদের ওপর নানা অত্যাচার চালাত। ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর বিশেষ এলাকায় তাদের বসবাস করতে হতো, ফুটপাতের ওপর দিয়ে তাদের হাঁটার অধিকার ছিল না, এমনকি রাত ন'টার পরে তাদের ঘরের বাইরে যাবার আইন ছিল না। এই সব অনাচার দূর করার উদ্দেশ্যে গান্ধীজি ভারতীয়দের সংঘবদ্ধ করে সম্পূর্ণ অহিংস পথে এক আন্দোলনের সূচনা করেন। 1914 খ্রিস্টাব্দে সরকার ‘ইন্ডিয়ান রিলিফ আইন' পাশ করলে গান্ধীজী আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। 1915 খ্রিস্টাব্দে 46 বছর বয়সে আফ্রিকা থেকে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু গোপাল কৃষ্ণ গোখলের পরামর্শে এই সময় তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। 1915 খ্রিস্টাব্দে তিনি আমেদাবাদে ‘সবরমতী আশ্রম' প্রতিষ্ঠা করেন। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক রাসকিন রচিত ‘unto the last', রুশ সাহিত্যিক টলস্টয় এর ‘Kingdom of God' এবং থরো ও এমারসন এর রচনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি সত্যাগ্রহ সম্পর্কে তার ধ্যান ধারণা গড়ে তোলেন। 'সত্য' ও ‘আগ্রহ’ অর্থাৎ সত্যের প্রতি আগ্রহ থেকেই ‘সত্যাগ্রহ' কথাটি এসেছে।
• চম্পারণ সত্যাগ্রহ : বিহারের চম্পারন জেলার নীলকররা স্থানীয় কৃষকদের মোট জমির 3/20 অংশে নীল চাষ করতে বাধ্য করতো এবং উৎপন্ন নিল কৃষকেরা নীলকরদের কাছে নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করতে বাধ্য ছিল। এই ব্যবস্থা ‘তিন কাঠিয়া ব্যবস্থা' নামে পরিচিত ছিল। কৃষকদের দুর্দশার অবস্থা অনুসন্ধানের জন্য গান্ধীজী 1917 খ্রিস্টাব্দে চম্পারণে উপস্থিত হন। তাকে বন্দি করে আদালতে হাজির করা হলেও সরকার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। 1917 খ্রিস্টাব্দে সরকার একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগ করে এবং ‘চম্পারন কৃষি বিল' পাস হলে চম্পারণে নীলকরদের শতবর্ষব্যাপী অত্যাচারের অবসান ঘটে।
• 1918 খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজী আরও দুটি সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছিলেন। গুজরাটের বেড়া জেলায় নিপীড়িত কৃষকদের জন্য এবং আমেদাবাদে মিল মজুরদের বেতন বৃদ্ধির জন্য।
• মুসলিম লীগ : ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ উৎসাহে 1906 খ্রিস্টাব্দের 31শে ডিসেম্বর আগা খাঁ, ঢাকার নবাব সালিমুল্লাহ এবং নবাব মহসিন-উল-মুলক এর নেতৃত্বে ঢাকায় ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়। আগা খাঁ ছিলেন মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি। মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গের সমর্থক ছিল এবং স্বদেশী আন্দোলনের বিরোধী ছিল। মহম্মদ আলী জিন্নাহ 1934 খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লীগের সভাপতি হন।
• চরমপন্থীদের কংগ্রেসে যোগদান : 1916 খ্রিস্টাব্দে অম্বিকাচরণ মজুমদার এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে চরমপন্থীরা পুনরায় কংগ্রেসে যোগদান করে।
• লক্ষ্ণৌ চুক্তি : তুরস্কের সুলতান ‘খলিফা’ বা মুসলিম জগতের ধর্মগুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ভারতীয় মুসলমানরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অপরদিকে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়ায় মুসলিম সমাজ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। 1914 খ্রিস্টাব্দে আবুল কালাম আজাদের ‘আল-হিলাল’ ও মৌলানা মহম্মদ আলীর’ পত্রিকা দুটি নিষিদ্ধ হয়। ব্রিটিশ বিরোধীতার জন্য মৌলানা মোহাম্মদ আলী, তার ভাই মৌলানা সৌকত আলী, হজরত মোহানি ও আবুল কালাম আজাদকে অন্তরীণ করা হয়। এইসব কারণে মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতার আগ্রহ দেখা যায়। ফলে 1916 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে লখনৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী মুসলিম লীগ কংগ্রেসের স্বরাজের আদর্শ মেনে নেয়, কংগ্রেসও মুসলিম লীগের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি মেনে নেয় ।
• হোমরুল আন্দোলন : শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত আয়ারল্যান্ডের রেমন্ডস-এর ‘হোমরুল লীগ' এর অনুকরণে ভারতে হোমরুল বা স্বায়ত্ব শাসন প্রবর্তনের কথা চিন্তা করেন। হোমরুল কথার অর্থ - প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক ব্যতীত শাসনব্যবস্থার প্রতিটি বিষয়ে ভারতীয়দের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। শ্রীমতি বেসান্ত 1914 খ্রিস্টাব্দে ‘কমন উইল' এবং ‘নিউ ইন্ডিয়া' পত্রিকা প্রকাশ করে তার আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। 1916 খ্রিস্টাব্দে শ্রীমতি বেসান্ত ‘হোমরুল লীগ' প্রতিষ্ঠা করেন। 1916 খ্রিস্টাব্দের 28 শে এপ্রিল জোসেফ ব্যাপ্টিস্টা এবং এন সি কেলকার কে যথাক্রমে সভাপতি ও সম্পাদক নিযুক্ত করে বালগঙ্গাধর তিলক ‘ইন্ডিয়ান হোমরুল লীগ' প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমে এই আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বালগঙ্গাধর তিলক ‘লোকমান্য’ অধ্যায় ভূষিত হন। এই সময় তিনি ঘোষণা করেন, “স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার এবং আমরা তা অর্জন করবই”। 1917 খ্রিস্টাব্দে শ্রীমতি বেসান্ত ও তার দুই সহকর্মীকে মাদ্রাস সরকার গ্রেফতার করলে, সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শেষ পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। 1917 খ্রিস্টাব্দে শ্রীমতি বেসান্তকে কলকাতা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
• মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসন দেবার জন্য ভারত সচিব মন্টেগু এবং ভারতের বড়লাট চেমসফোর্ড 1918 খ্রিস্টাব্দের 22 এপ্রিল একটি রিপোর্ট দাখিল করেন। এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে 1919 খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার পাস করা হয়। এই আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও আয় সুনির্দিষ্টভাবে বন্টন করা হয়। কেন্দ্রে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। নিম্নকক্ষের নাম হয় ‘কেন্দ্রীয় আইনসভা' এবং উচ্চকক্ষের নাম হয় ‘রাষ্ট্রিয় পরিষদ’। প্রাদেশিক আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট হয়। এই প্রস্তাব নিয়ে নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে বিরোধ বাধে (নরমপন্থীরা এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানান) এবং নরমপন্থীরা 1919 খ্রিস্টাব্দে ‘ন্যাশনাল লিবারেল ফেডারেশন' গঠন করে কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
• রাওলাট আইন : ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলনের বিস্তার এবং তার সম্ভাব্য প্রতিরোধ সর্ম্পকে বিচার বিবেচনার জন্য 1917 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বিচারপতি লর্ড রাওলাট এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ‘রাওলাট কমিটি' বা ‘সিডিশন কমিটি' গঠিত হয়। এই কমিটির সুপারিশে 1919 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় আইনসভায় দুটি দমনমূলক বিল উত্থাপিত হয় - সরকারবিরোধী যে কোন প্রচার দণ্ডনীয় বলে বিবেচিত হবে, সন্দেহভাজন যে কোন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে। 1919 খ্রিস্টাব্দের 18ই মার্চ বিলটি আইনে পরিণত হয় । মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মদনমোহন মালব্য ও মাজহার-উল-হক এই আইনের প্রতিবাদে আইন পরিষদের সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দেন। 1919 খ্রিস্টাব্দে 30 মার্চ ও 6 এপ্রিল গান্ধীজীর ডাকে দেশজুড়ে বৃহত্তম হরতাল পালিত হয়।
• জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড : 1919 খ্রিস্টাব্দের 13 ই এপ্রিল দমনমূলক রাওলাট আইনের প্রতিবাদে পাঞ্জাবের অমৃতসরে জলিয়ানওয়ালাবাগ নামে প্রাচীর ঘেরা এক উদ্যানে 10 হাজার মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। ছোটলাট রেজিনল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ার সমাবেশের প্রতি কোনরূপ নিষেধাজ্ঞা জারি না করে এবং জনগণকে কোনরূপ সতর্ক না করে সেনাবাহিনী নিয়ে সভাস্থল ঘিরিফেলেন এবং চারটি প্রবেশপথ আটক করেন। তার নির্দেশে 100 গজ দূর থেকে 50 টি রাইফেলের সাহায্যে 10 মিনিটে 1600 রাউন্ড গুলি চালানো হয়। এই ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হন। সরকারি হিসাবে 379 জন নিহত এবং 1200 জন আহত হন। ক্রুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনার প্রতিবাদে ইংরেজদের দেওয়া 'নাইট' উপাধি ত্যাগ করেন।
• খিলাফৎ আন্দোলন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের খলিফা মিত্রপক্ষের শত্রু জার্মানির সঙ্গে যোগ দেয়। যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে জার্মানির পরাজয়ে খলিফারও পড়াজয় ঘটে। 1919 খ্রিস্টাব্দে ‘ভার্সাই শান্তি সমাবেশে' পরাজিত দেশগুলির সঙ্গে মোট পাঁচটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মধ্যে তুরস্কের সঙ্গে 1920 খ্রিস্টাব্দে 14 ই মে স্বাক্ষরিত ‘সেভরের শান্তি চুক্তি' অনুযায়ী অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে আলি ভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ মহম্মদ আলি ও সৌকত আলি 1919 খ্রিস্টাব্দের 17 ই অক্টোবর ‘খিলাফৎ দিবস' পালনের মাধ্যমে ভারতে খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করেন। খলিফার পার্থিব সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন রাখা, মেসোপটেমিয়া, আরব, প্যালেস্তাইন ও সিরিয়ার উপর খলিফার অধিকার অক্ষুন্ন রাখা এবং মক্কা ও মদিনার উপর বিদেশী হস্তক্ষেপ বন্ধ করা – এই ছিল খিলাফৎ কমিটির তিনটি দাবি। খিলাফত আন্দোলনে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের সুযোগ থাকায় গান্ধীজি এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। 1920 খ্রিস্টাব্দে 1 লা আগস্ট ভারতবর্ষ ব্যাপি এক সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। গান্ধীজি ওই দিন ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘কাইজার-ই-হিন্দ' স্বর্ণ পদক ফিরিয়ে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। 1920 খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে কংগ্রেসে ‘বিশেষ কলকাতা অধিবেশনে' খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করে। 1924 খ্রিস্টাব্দে মুস্তাফা কমল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে খলিফা পদের অবসান ঘটলে খিলাফত আন্দোলন অপ্রয়োজীয় হয়ে পড়ে।
• চম্পারণ সত্যাগ্রহ : বিহারের চম্পারন জেলার নীলকররা স্থানীয় কৃষকদের মোট জমির 3/20 অংশে নীল চাষ করতে বাধ্য করতো এবং উৎপন্ন নিল কৃষকেরা নীলকরদের কাছে নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করতে বাধ্য ছিল। এই ব্যবস্থা ‘তিন কাঠিয়া ব্যবস্থা' নামে পরিচিত ছিল। কৃষকদের দুর্দশার অবস্থা অনুসন্ধানের জন্য গান্ধীজী 1917 খ্রিস্টাব্দে চম্পারণে উপস্থিত হন। তাকে বন্দি করে আদালতে হাজির করা হলেও সরকার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। 1917 খ্রিস্টাব্দে সরকার একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগ করে এবং ‘চম্পারন কৃষি বিল' পাস হলে চম্পারণে নীলকরদের শতবর্ষব্যাপী অত্যাচারের অবসান ঘটে।
• 1918 খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজী আরও দুটি সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছিলেন। গুজরাটের বেড়া জেলায় নিপীড়িত কৃষকদের জন্য এবং আমেদাবাদে মিল মজুরদের বেতন বৃদ্ধির জন্য।
• মুসলিম লীগ : ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ উৎসাহে 1906 খ্রিস্টাব্দের 31শে ডিসেম্বর আগা খাঁ, ঢাকার নবাব সালিমুল্লাহ এবং নবাব মহসিন-উল-মুলক এর নেতৃত্বে ঢাকায় ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়। আগা খাঁ ছিলেন মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি। মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গের সমর্থক ছিল এবং স্বদেশী আন্দোলনের বিরোধী ছিল। মহম্মদ আলী জিন্নাহ 1934 খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লীগের সভাপতি হন।
• চরমপন্থীদের কংগ্রেসে যোগদান : 1916 খ্রিস্টাব্দে অম্বিকাচরণ মজুমদার এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে চরমপন্থীরা পুনরায় কংগ্রেসে যোগদান করে।
• লক্ষ্ণৌ চুক্তি : তুরস্কের সুলতান ‘খলিফা’ বা মুসলিম জগতের ধর্মগুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ভারতীয় মুসলমানরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অপরদিকে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়ায় মুসলিম সমাজ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। 1914 খ্রিস্টাব্দে আবুল কালাম আজাদের ‘আল-হিলাল’ ও মৌলানা মহম্মদ আলীর’ পত্রিকা দুটি নিষিদ্ধ হয়। ব্রিটিশ বিরোধীতার জন্য মৌলানা মোহাম্মদ আলী, তার ভাই মৌলানা সৌকত আলী, হজরত মোহানি ও আবুল কালাম আজাদকে অন্তরীণ করা হয়। এইসব কারণে মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতার আগ্রহ দেখা যায়। ফলে 1916 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে লখনৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী মুসলিম লীগ কংগ্রেসের স্বরাজের আদর্শ মেনে নেয়, কংগ্রেসও মুসলিম লীগের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি মেনে নেয় ।
• হোমরুল আন্দোলন : শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত আয়ারল্যান্ডের রেমন্ডস-এর ‘হোমরুল লীগ' এর অনুকরণে ভারতে হোমরুল বা স্বায়ত্ব শাসন প্রবর্তনের কথা চিন্তা করেন। হোমরুল কথার অর্থ - প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক ব্যতীত শাসনব্যবস্থার প্রতিটি বিষয়ে ভারতীয়দের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। শ্রীমতি বেসান্ত 1914 খ্রিস্টাব্দে ‘কমন উইল' এবং ‘নিউ ইন্ডিয়া' পত্রিকা প্রকাশ করে তার আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। 1916 খ্রিস্টাব্দে শ্রীমতি বেসান্ত ‘হোমরুল লীগ' প্রতিষ্ঠা করেন। 1916 খ্রিস্টাব্দের 28 শে এপ্রিল জোসেফ ব্যাপ্টিস্টা এবং এন সি কেলকার কে যথাক্রমে সভাপতি ও সম্পাদক নিযুক্ত করে বালগঙ্গাধর তিলক ‘ইন্ডিয়ান হোমরুল লীগ' প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমে এই আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বালগঙ্গাধর তিলক ‘লোকমান্য’ অধ্যায় ভূষিত হন। এই সময় তিনি ঘোষণা করেন, “স্বরাজ আমাদের জন্মগত অধিকার এবং আমরা তা অর্জন করবই”। 1917 খ্রিস্টাব্দে শ্রীমতি বেসান্ত ও তার দুই সহকর্মীকে মাদ্রাস সরকার গ্রেফতার করলে, সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শেষ পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। 1917 খ্রিস্টাব্দে শ্রীমতি বেসান্তকে কলকাতা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
• মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার : ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসন দেবার জন্য ভারত সচিব মন্টেগু এবং ভারতের বড়লাট চেমসফোর্ড 1918 খ্রিস্টাব্দের 22 এপ্রিল একটি রিপোর্ট দাখিল করেন। এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে 1919 খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার পাস করা হয়। এই আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও আয় সুনির্দিষ্টভাবে বন্টন করা হয়। কেন্দ্রে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। নিম্নকক্ষের নাম হয় ‘কেন্দ্রীয় আইনসভা' এবং উচ্চকক্ষের নাম হয় ‘রাষ্ট্রিয় পরিষদ’। প্রাদেশিক আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট হয়। এই প্রস্তাব নিয়ে নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে বিরোধ বাধে (নরমপন্থীরা এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানান) এবং নরমপন্থীরা 1919 খ্রিস্টাব্দে ‘ন্যাশনাল লিবারেল ফেডারেশন' গঠন করে কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
• রাওলাট আইন : ভারতে বৈপ্লবিক আন্দোলনের বিস্তার এবং তার সম্ভাব্য প্রতিরোধ সর্ম্পকে বিচার বিবেচনার জন্য 1917 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বিচারপতি লর্ড রাওলাট এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ‘রাওলাট কমিটি' বা ‘সিডিশন কমিটি' গঠিত হয়। এই কমিটির সুপারিশে 1919 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় আইনসভায় দুটি দমনমূলক বিল উত্থাপিত হয় - সরকারবিরোধী যে কোন প্রচার দণ্ডনীয় বলে বিবেচিত হবে, সন্দেহভাজন যে কোন ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে। 1919 খ্রিস্টাব্দের 18ই মার্চ বিলটি আইনে পরিণত হয় । মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মদনমোহন মালব্য ও মাজহার-উল-হক এই আইনের প্রতিবাদে আইন পরিষদের সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দেন। 1919 খ্রিস্টাব্দে 30 মার্চ ও 6 এপ্রিল গান্ধীজীর ডাকে দেশজুড়ে বৃহত্তম হরতাল পালিত হয়।
• জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড : 1919 খ্রিস্টাব্দের 13 ই এপ্রিল দমনমূলক রাওলাট আইনের প্রতিবাদে পাঞ্জাবের অমৃতসরে জলিয়ানওয়ালাবাগ নামে প্রাচীর ঘেরা এক উদ্যানে 10 হাজার মানুষের সমাবেশ হয়েছিল। ছোটলাট রেজিনল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ার সমাবেশের প্রতি কোনরূপ নিষেধাজ্ঞা জারি না করে এবং জনগণকে কোনরূপ সতর্ক না করে সেনাবাহিনী নিয়ে সভাস্থল ঘিরিফেলেন এবং চারটি প্রবেশপথ আটক করেন। তার নির্দেশে 100 গজ দূর থেকে 50 টি রাইফেলের সাহায্যে 10 মিনিটে 1600 রাউন্ড গুলি চালানো হয়। এই ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হন। সরকারি হিসাবে 379 জন নিহত এবং 1200 জন আহত হন। ক্রুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনার প্রতিবাদে ইংরেজদের দেওয়া 'নাইট' উপাধি ত্যাগ করেন।
• খিলাফৎ আন্দোলন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের খলিফা মিত্রপক্ষের শত্রু জার্মানির সঙ্গে যোগ দেয়। যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে জার্মানির পরাজয়ে খলিফারও পড়াজয় ঘটে। 1919 খ্রিস্টাব্দে ‘ভার্সাই শান্তি সমাবেশে' পরাজিত দেশগুলির সঙ্গে মোট পাঁচটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মধ্যে তুরস্কের সঙ্গে 1920 খ্রিস্টাব্দে 14 ই মে স্বাক্ষরিত ‘সেভরের শান্তি চুক্তি' অনুযায়ী অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে আলি ভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ মহম্মদ আলি ও সৌকত আলি 1919 খ্রিস্টাব্দের 17 ই অক্টোবর ‘খিলাফৎ দিবস' পালনের মাধ্যমে ভারতে খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করেন। খলিফার পার্থিব সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন রাখা, মেসোপটেমিয়া, আরব, প্যালেস্তাইন ও সিরিয়ার উপর খলিফার অধিকার অক্ষুন্ন রাখা এবং মক্কা ও মদিনার উপর বিদেশী হস্তক্ষেপ বন্ধ করা – এই ছিল খিলাফৎ কমিটির তিনটি দাবি। খিলাফত আন্দোলনে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের সুযোগ থাকায় গান্ধীজি এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। 1920 খ্রিস্টাব্দে 1 লা আগস্ট ভারতবর্ষ ব্যাপি এক সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। গান্ধীজি ওই দিন ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘কাইজার-ই-হিন্দ' স্বর্ণ পদক ফিরিয়ে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। 1920 খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে কংগ্রেসে ‘বিশেষ কলকাতা অধিবেশনে' খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করে। 1924 খ্রিস্টাব্দে মুস্তাফা কমল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে খলিফা পদের অবসান ঘটলে খিলাফত আন্দোলন অপ্রয়োজীয় হয়ে পড়ে।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.